তালাত মাহামুদ বিশেষ প্রতিনিধি।
ইয়া মোহাম্মদ মোস্তফা নবী সাল্লে আলা, ওরে শাফায়াতের কান্ডারী মদিনা ওয়ালা”—এই সুরটি শোনেননি এমন ধর্মপ্রাণ মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। প্রতিটি মিলাদ, মাহফিল কিংবা আধ্যাত্মিক আসরে এই কালজয়ী নাতে রাসুলটি মানুষের হৃদয়ে ভক্তির জোয়ার আনে। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো, এই জনপ্রিয় গানের মূল স্রষ্টা আবু বকর সিদ্দিক আজ জীবনসায়াহ্নে এসে চরম অবহেলা আর নিদারুণ অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ডিবিসি নিউজের এক বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এই নিভৃতচারী শিল্পীর জীবনযুদ্ধের এক করুণ ও বাস্তব চিত্র।
বিটিভির তালিকাভুক্ত হয়েও কেন আজ দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন কয়েক হাজার গজলের এই অমর স্রষ্টা?” — ঠিক এই প্রশ্নটিই আজ বিদ্ধ করছে আমাদের বিবেককে।
যিনি কয়েক দশক ধরে বাংলার আকাশে-বাতাসে আধ্যাত্মিক সুরের মূর্ছনা ছড়িয়ে দিয়েছেন, যার কলম থেকে নিসৃত হয়েছে কয়েক হাজার কালজয়ী হামদ-নাত, গজল আর মুর্শিদী গান, সেই নিভৃতচারী শব্দসৈনিক আবু বক্কর সিদ্দিক আজ অবহেলার ধুলোয় মলিন হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। নরসিংদীর রায়পুরার হাসিমপুর গ্রামের এক জীর্ণ কুটিরে আজ নিঃশব্দে কাঁদছে তার হাজার হাজার পাণ্ডুলিপি। ১৯৫৫ সালের ১ জানুয়ারি জন্ম নেওয়া এই মানুষটি শৈশব থেকেই ছিলেন মরমী চেতনার অধিকারী। গ্রামের পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে নির্জনে বসে যে শব্দসাধনা তিনি শুরু করেছিলেন, তা আজও থামেনি; থেমেছে কেবল তার সৃষ্টির ডানা মেলার সামর্থ্য।
আবু বক্কর সিদ্দিক কেবল একজন তুখোড় গীতিকারই নন, তিনি একজন গর্বিত বীর মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পক্ষে লড়তে গিয়ে তিনি সম্মুখ সমরে আহত হয়েছিলেন। তার মেধার স্বাক্ষর তিনি রেখেছিলেন ১৯৭০ সালেই, যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের ছাত্র থাকাকালীন ‘আশুগঞ্জ বিদ্যুৎ পরিকল্পনা’ রচনা প্রতিযোগিতায় স্বর্ণপদক লাভ করেন। পরবর্তী সময়ে ২০০৫ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের (বিটিভি) তালিকাভুক্ত গীতিকার হিসেবে স্বীকৃতি পান। তার লেখা ও সুর করা কালজয়ী গানগুলোর মধ্যে “ইয়া মোহাম্মদ মোস্তফা নবী সাল্লে আলা, ওরে শাফায়াতের কান্ডারী মদিনা ওয়ালা” গানটি আজ প্রতিটি ধর্মপ্রাণ মানুষের হৃদয়ে গেঁথে আছে। এছাড়াও তার লেখনীতে প্রাণ পেয়েছে “সর্বনাশা পদ্মা নদী তোর কাছে শুধাই”, “নিরিখ বান্ধরে দুই নয়নে”, “মাটিরও পিঞ্জিরার মাঝে বন্দি হইয়ারে” এবং “নিদয়া রে”-র মতো অসংখ্য জনপ্রিয় গান। তার এই মরমী ও বিচ্ছেদী গানে কণ্ঠ দিয়ে দেশজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন ফরিদা পারভীন, মৌলভী তোফাজ্জল হোসেন ভৈরবী, মাওলানা মোজাম্মেল হক, কণ্ঠশিল্পী মনির ও মোস্তফার মতো কিংবদন্তিরা।
অথচ আজ বাস্তবতার চিত্রটি বড়ই করুণ। তার ঘরে থরে থরে সাজানো প্রায় ২০ হাজার গানের পাণ্ডুলিপি আজ উইপোকায় কাটছে। অর্থের অভাবে “বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর নগর কাব্যগ্রন্থ” ও “আবু বক্কর সিদ্দিকের লেখা ৩৫টি গজল”-সহ তার অমূল্য সৃষ্টিগুলো আজও বই আকারে আলোর মুখ দেখেনি। যে মানুষটি আমাদের হৃদয় শীতল করা গান উপহার দিয়েছেন, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে তাকেই আজ নিজের চিকিৎসার খরচ আর সৃষ্টির সুরক্ষার জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ধরণা দিতে হচ্ছে। আবু বক্কর সিদ্দিক আমাদের লোকজ সংস্কৃতির এক জীবন্ত আর্কাইভ। সময় ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই এই গুণী মুক্তিযোদ্ধার সৃষ্টিগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণ করা এবং তাকে যোগ্য সম্মান ও সহায়তা প্রদান করা আমাদের জাতীয় দায়িত্ব।